মানুষ মাত্রই কোন না কোন ভাবে ভূমির উপর নির্ভরশীল। তন্মধ্যে আমাদের কৃষি নির্ভরশীল দেশে ভূমির গুরুত্ব আরও বেশী। ক্রমাগত জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে সংকট দিনদিন প্রকটতর হচ্ছে। বিভিন্ন কারণে এদেশে ভূমি ব্যবস্থাপনা ও ভূমি আইনের জটিলতা আবহমান কাল ধরে চলে আসছে। ভূমি ব্যবস্থাপনা সুদীর্ঘকাল ধরে এতদাঞ্চলের রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের মুখ্য ভিত্তি হিসেবে পরিচালিত হয়ে আসছে। দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক কাঠামো অত্যন্ত গভীরভাবে ভূমি ব্যবস্থাপনার সাথে সম্পৃক্ত। এর রয়েছে সুদীর্ঘ ঐতিহ্য। অতীতে ভূমি ব্যবস্থাপনা বলতে মূলতঃ কর আদায়ভিত্তিক ব্যবস্থাপনা বুঝাতো। বর্তমানে ভূমি ব্যবস্থাপনা বলতে শুধু কর আদায়কেই বুঝায় না বরং ভূমি ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়নের মাধ্যমে গণমানুষের ভোগান্তি হ্রাসসহ ভূমির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে একটি দক্ষ প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে বুঝায়। তদানীন্তন ভারতের অংশ হিসাবে এদেশে সব প্রথম ১৭৮৬ সালে ভূমি ব্যবস্থাপনা ও ভূমি রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী কর্তৃক “বোর্ড অব রেভিনিউ” গঠিত হয়। পরবর্তীতে এই বোর্ডের অধীনে সিভিল সার্ভিস সদস্যরা রাজস্ব বিষয়ক নীতি নির্ধারণ, রাজস্ব ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে বিভিন্ন আইনকানুন প্রণয়ন করতেন এবং বোর্ড অব রেভিনিউর পরামর্শ গ্রহণ করতেন। তখন বোর্ডের প্রধান কাজ ছিল রাজস্ব প্রশাসন সম্পর্কে কালেক্টর এর কার্যাবলী তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ করা। এরপর বিভিন্ন সময়ে কমিশনার, কালেক্টর পদ সৃষ্টি এবং রাজস্ব বোর্ড গঠনের মাধ্যমে ভূমি ব্যবস্থাপনার প্রশাসনিক কাঠামোকে দৃঢ় করার পদক্ষেপ নেয়া হয়। স্বাধীনতা পরবর্তী ১৯৭২ সনে ‘‘বোর্ড অব রেভিনিউ’’ বিলুপ্ত হলে বোর্ডের সকল দায়িত্ব তৎকালীন ভূমি প্রশাসন ও ভূমি সংস্কার মন্ত্রণালয়ের অন্তর্ভূক্ত হয়।
১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত আইন প্রণয়নের ফলে রাজস্ব প্রশাসনে নানা জটিলতার সৃষ্টি হয়। তখন জমিদারী প্রথা, নওয়াব, রাজা ও মহারাজাদের কাযক্রম ১৭৯৩ সনের স্থায়ী বন্দোবস্ত রেগুলেশন মতে নিয়ন্ত্রিত হতো। যাবতীয় রাজস্ব সংক্রান্ত মামলার ট্রাইবুনাল হিসাবে বোড অব রেভিনিউ কাজ করতো। কিন্তু রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন-১৯৫০ বহালের পর কিছু কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া রাজস্ব বিষয়ক প্রায় সকল আইন বাতিল হয়। এছাড়া ২৫ বিঘা পর্যন্ত খাজনা মওকুফ ও হাট-বাজার ইজারা তারিখ/সন প্রদান পদ্ধতি ভিন্নতর হওয়ায় বোড অব রেভিনিউর গুরুত্ব, কম বিবেচিত হওয়ায় এবং পরবর্তীতে মন্ত্রণালয় কর্তৃক এ নির্বাহী দায়িত্ব পালনের সুযোগ সৃষ্টি হওয়ায় “বোর্ড অব রেভিনিউ” বিলুপ্ত ঘোষিত হয়।
এ ব্যবস্থাপনায় মাঠ পর্যায়ে ভূমি প্রশাসন পরিচালনা, আপীল নিষ্পত্তি ইত্যাদি অতিরিক্ত দায়িত্ব ভূমি মন্ত্রণালয়ের উপর ন্যস্ত করা হলে তা নীতি নির্ধারণীর মূল দায়িত্বের সাথে অতিরিক্ত চাপের সৃষ্টি করে। ফলে পূর্বের ‘‘বোর্ড অব রেভিনিউ’’ এর মত একটি বোর্ড গঠনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। পরবর্তীতে ভূমি সংক্রান্ত যাবতীয় জটিলতা নিরসনকল্পে ১৯৮০ এর দশক অনুরূপ বোর্ডের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়ায় ১৯৮১ সনের ১৩ নং আইন প্রবর্তনের মাধ্যমে “ভূমি প্রশাসন বোর্ড” সৃষ্টি করা হয়। ১৯৮২ সালের শেষদিকে ভূমি প্রশাসন বোর্ড এর কার্যক্রম শুরু হয়। পরবর্তীতে জাতীয় ভূমি সংস্কার কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৯৮৯ সনের ১৬ মার্চ ভূমি আপীল বোর্ড অধ্যাদেশ, ১৯৮৯ ও ভূমি সংস্কার বোর্ড অধ্যাদেশ, ১৯৮৯ অনুযায়ী ভূমি প্রশাসন বোর্ডকে ভেঙ্গে যথাক্রমে ভূমি সংস্কার বোর্ড ও ভূমি আপীল বোর্ড নামে দুটি বোর্ড সৃষ্টি করা হয়।
ভূমি রাজস্ব মামলায় জনগণের সুবিচার প্রাপ্তি, মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি এবং মামলার ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে ভূমি আপীল বোর্ড অধ্যাদেশ, ১৯৮৯ (অধ্যাদেশ নং ২, ১৯৮৯) এর মাধ্যমে ভূমি আপীল বোর্ড গঠিত হয়। উক্ত অধ্যাদেশ পরবর্তী জাতীয় সংসদে পাস হয় ও ৩১ মে, ১৯৮৯ তারিখে মহামান্য রাষ্ট্রপতির সম্মতি লাভ করে এবং ভূমি আপীল বোর্ড আইন ১৯৮৯ (আইন নং ২৪, ১৯৮৯) নামে অভিহিত হয়।